Al Jazeera Bangla : যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিস্তৃত এবং এর ঐতিহাসিক ভাবে এর শিকড় বিস্তৃত। তবে প্রেসিডেন্ট জো বিডেনের প্রশাসনের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটির উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
প্রথমত, ৯ এবং ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বাইডেনের উচ্চ পর্যায়ের ভার্চুয়াল সামিট ফর ডেমোক্রেসিতে আমন্ত্রিত ১১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল না।
এরপর শুক্রবার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অভিজাত আধাসামরিক বাহিনী, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাতজন বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তার উপর মানবাধিকার-সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। র্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে শত শত গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার অর্থ হচ্ছে র্যাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনও ধরণের সম্পত্তির মালিক হতে পারবে না বা কোনও মার্কিন সংস্থা বা ব্যক্তির সাথে কোনও আর্থিক লেনদেন করতে পারবে না। এছাড়া এই নিষেধাজ্ঞায় বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ সহ র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাতজন শীর্ষ কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশের স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের মার্কিন ভিসাও প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং তাকে যুক্তরাষ্ট্রে “অবাঞ্ছিত” ঘোষণা করা হয়েছে।
এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে, আল জাজিরার একটি তদন্ত - অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন - প্রকাশ করেছে কিভাবে জেনারেল আহমেদ তার ভাই হারিস আহমেদকে ১৯৯৬ সালের একটি হত্যাকাণ্ডের দায়ে কারাদণ্ড থেকে বাঁচতে সাহায্য করেছেন। অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে সাবেক এই সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে গুরুতর স্বজনপ্রীতি এবং অসৎ আচরণের অভিযোগ রয়েছে।
এখন পর্যন্ত, র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ঢাকার প্রতিক্রিয়া ছিল দৃশ্যমান এবং বিক্ষিপ্ত। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষ সম্মেলনে “সম্ভবত শুধুমাত্র দুর্বল গণতন্ত্রকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে”। এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, আধাসামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাগুলি “অতিরঞ্জিত খবর” এর উপর ভিত্তি করে আরোপ করা হয়েছে।
তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত শনিবার বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলারকে তলব করে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ঢাকার হতাশা প্রকাশ করেছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য যেখানে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের চালান হয়ে থাকে, যার প্রায় ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক (আরএমজি)। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রতিযোগিতামূলক আরএমজি শিল্পের আবাসস্থল, যা গত দুই দশকে দেশের বার্ষিক বৃদ্ধির হার গড়ে সাত শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও দক্ষিণ এশীয় দেশটির অন্যতম বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার, প্রায় ১৬০ মিলিয়ন লোকের আবাসস্থল, এবং বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের নিরাপত্তা কর্মকর্তা এবং পুলিশকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মতে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের পর এশিয়ায় মার্কিন সহায়তার সবচেয়ে বড় গ্রহীতা বাংলাদেশ।
এই পটভূমিতে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক মার্কিন প্রশাসনের পদক্ষেপগুলি শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীত্বে মানবাধিকারের ক্রমাগত স্খলন এবং “স্বৈরাচারের দিকে ঝুঁকতে” থাকা বাংলাদেশের জন্য একটি “সতর্ক বার্তা” বলে মনে হচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন সিডনির অ্যাডজেন্ট রিসার্চ ফেলো মুবাশার হাসান আল জাজিরাকে বলেছেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে বোঝা যায় যে বাইডেন প্রশাসন কেবলমাত্র বাংলাদেশেই নয়, সাধারণভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে স্থাপন করে একটি “উল্লেখযোগ্য নীতিগত পরিবর্তন” করেছে। এবং এর বৈদেশিক সম্পর্কের কেন্দ্রে মানবাধিকার স্থান পেয়েছে।
হাসান আরও বলেন, “সম্ভবত বাইডেন বুঝতে পেরেছেন যে গণতন্ত্রের ধারণা বিদেশে তার আবেদন হারিয়ে ফেললে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদেরকে কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে আলাদা করা কঠিন হবে।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন, র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার সময় বলেছেন, “আমরা আমাদের বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রে মানবাধিকারকে আগ্রাধিকার দিচ্ছি। মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অপব্যবহারের জন্য দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে আমরা উপযুক্ত সরঞ্জাম এবং কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করে আমরা এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করবো।”
বাংলাদেশী মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন আল জাজিরাকে বলেছেন, নথিভুক্ত প্রতিবেদনগুলি স্পষ্টভাবে নিশ্চিত করে যে র্যাব বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং জোরপূর্বক গুম সহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত।
“আমরা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ সরকারকে গুম এবং ক্রসফায়ারের তদন্তের স্বার্থে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের জন্য বলে আসছি, কিন্তু সরকার আমাদের আহ্বানে কর্ণপাত করেনি,” বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন “যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টতই একটি দেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং তারা বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই র্যাবকে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় অবাক হওয়ার কিছু নেই।”
গত এক দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) র্যাবের ওপর চারটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে এর অধিকার লঙ্ঘনের বিবরণ রয়েছে। ২০১১ সালের প্রতিবেদনে, ‘ক্রসফায়ার: বাংলাদেশের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘন’ শিরোনামে এইচআরডব্লিউ আধাসামরিক বাহিনীটির দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।
এইচআরডব্লিউ-এর ২০১৭ সালের উই ডোন্ট হ্যাভ হিম শিরোনামে প্রকাশিত গোপন আটক এবং জোরপূর্বক গুমের উপর প্রতিবেদন, এই ধরনের অনেক ঘটনার জন্য র্যাবকে দায়ী বলে চিহ্নিত করেছে।
এ বিষয়ে র্যাবের উপ-প্রধান কে এম আজাদ, তার বাহিনীর অভিযানের স্বপক্ষে বলেছেন, এটি কখনও মানবাধিকার লঙ্ঘন করে না।
গত সপ্তাহে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, “যদি কোনও অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়, তাহলে দেশের স্বার্থে এই মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।”
নিষেধাজ্ঞার বৃহত্তর প্রভাব
আল জাজিরাকে দেওয়া এক লিখিত বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “আমরা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্বকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করি এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিবিড়ভাবে কাজ করি। মানবাধিকার ও আইনের শাসন সমুন্নত রাখার গুরুত্ব নিয়ে আমরা বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমরা অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে সহযোগিতা করার পাশাপাশি আমাদের উদ্বেগ উত্থাপন করতে থাকব।”
তবে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
ওয়াশিংটন, ডিসিতে অবস্থিত থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়ার উপ-পরিচালক এবং সিনিয়র সহযোগী মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, নিষেধাজ্ঞাগুলি থেকে বোঝা যায় যে বাইডেন প্রশাসন “ঢাকায় কৌশলগত তাত্পর্যের সাথে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক নয়, তবে অনেকে বিশ্বাস করেন যে এটি প্রয়োজন”। .
তিনি আরও বলেন, “কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে চায় তাদের নেতাদের নিষেধাজ্ঞা দেয় না। বিষয়টি অবশ্যই কিছুটা আশ্চর্যজনক, কারণ মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকায় গিয়ে সম্পর্কের গুণগান করছিলেন।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ভারত মহাসাগরের তীরে অবস্থানের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে “বাংলাদেশকে একটি বিশিষ্ট অবস্থান দখল করতে” এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও চীনের মধ্যে প্রভাবের বিস্তারের “টানাপোড়েনের” অংশ হতে দেখা যেতে পারে।
কুগেলম্যান বলেন, “ঢাকা ঘটনাক্রমে টানাপোড়েনের অংশ নয়।” “সুতরাং কেউ ভাবতে পারেন যে মার্কিন বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে চাইবে, কিন্তু র্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার এই পদক্ষেপ থেকে বোঝা যায় যে ওয়াশিংটন সম্পর্কে তাদের এই চিন্তাভাবনা ভুল।”
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হয়তো “ঢাকা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে এই পদক্ষেপ নেয়নি, বরং একটি কঠিন বার্তা পাঠানোর জন্য নিয়েছে, যে তারা আরও ঘটিষ্ট হতে চায়”। তবে শুধুমাত্র ঢাকা যদি তার মানবাধিকারের রেকর্ড উন্নত করে তাহলে সেটা সম্ভব।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির বিশিষ্ট অধ্যাপক আলী রিয়াজ আল জাজিরাকে বলেছেন, সাম্প্রতিক মার্কিন পদক্ষেপগুলি বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতির সম্পূর্ণ পরিবর্তনের চিহ্নি নয়। তবে এটি একটি ইঙ্গিত যে “যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্য কমে হয়ে আসছে”।
তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই, ওয়াশিংটন বাংলাদেশকে ভারতীয় প্রিজমের মাধ্যমে দেখত, কিন্তু এই ঘটনা (নিষেধাজ্ঞা) ইঙ্গিত দেয় যে যুক্তরাষ্ট্র তার ভারত নীতি থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করছে।”
“এই পদক্ষেপগুলি মানবাধিকারের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের মনোযোগের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ। এই পদক্ষেপগুলি এই দুই দেশের মধ্যে কিছুটা উত্তেজনা তৈরি করবে।”
রিয়াজ বলেন, যুক্তরাজ্য বা কানাডার মতো অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপে যোগ দেবে কি না তা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব নির্ধারণ করবে।
“কিন্তু প্রশ্ন হল মার্কিন পদক্ষেপগুলি কি আদৌ ফলপ্রসূ হবে এবং তা কি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে ঠেলে দেবে? যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হবে। একটি স্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে যে চীন এই পরিস্থিতির সুবিধা নেবে এবং বাংলাদেশে তার প্রভাব বাড়াতে নিয়োজিত হবে,” তিনি আরও বলেন।
সূত্র: আল জাজিরা ইংরেজি।